উত্থান-পতন

মারিয়াম যখন খুব ছোট তখন তার মা তাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। নিজের নাচ শেখার ইচ্ছেটাকে মেয়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবতায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন বলেই হয়ত। ছোট্ট মারিয়াম কিন্তু বেশ পছন্দই করেছিল নৃত্যকলার এই বিদ্যাকে। তারপর অকস্মাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায় নাচ শেখা। কারণটা যদিও ছিল বাজে খরচ ঠেকানো, কিন্তু তারা ছিল বাঙালি – তাও আবার মধ্যবিত্ত মুসলিম। তারা শুধু নামে মুসলিম হলেও কারণ হিসেবে মারিয়ামকে যা বলা হলো তা হলো “নাচ তো ইসলামে নিষিদ্ধ, তোমার নানা-নানী এটাকে পছন্দ করবেন না। তুমি বরং বাদ দাও।”

আশ্চর্য ব্যাপার, যখন নাচ শেখা শুরু করেছিল তখন তাহলে নানা-নানীর কথা কেন শোনেনি? যদিও এখন মারিয়াম বোঝে সেটা কত বড় ব্লেসিং ছিল তার জন্য আল্লাহ্‌র তরফ থেকে।

বাবা মা ছিলেন সেক্যুলার মুসলিম, অন্য কোনো যুক্তি তর্কে কাজ না হলে বলে দাও আরেহ ইসলামে তো নিষিদ্ধ করা যাবে না।

ছোটবেলায় এই জিনিসগুলো বেশ কষ্ট দিত মারিয়াম কে। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সে।

হুজুরের কাছে আরবী পড়ত সে। বাবার বদলী চাকরির জন্য সেই আরবী পড়া শেখাটা সম্পূর্ণ হয়নি মারিয়ামের। এরপরে নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে ভর্তি হয় মারিয়াম। পড়াশোনায় ভালো, আবৃত্তি তে ভালো, লিডারশীপ কোয়ালিটি ও বেশ, বই পড়তে ভালোবাসে খুব। আবার বাবা-মার ঝোঁক চাপে মেয়েকে গান শেখাবেন, সেই সাথে কুরআনও শেখা দরকার। গানের ক্লাসে গেল একদিন। সারেগামা সেরে আসল। গানের সেই শিক্ষক খুব প্রশংসা করলেন মারিয়ামের। তারপর….

গানের ক্লাসের খরচটা বেশ বেশি, তার উপর হারমোনিয়াম, তবলা কেনার খরচ। বাবার সামর্থ্যে কুলাবে না জানতো মারিয়াম। তারপর আরবী শিখার জন্য যেই আপুর কাছে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, সেই ক্লাসের সময় আবার গানের ক্লাসের সাথে মিলে যাচ্ছিল।

এবার অবশ্য নানা-নানীর পছন্দ বা ইসলামিক অনুশাসন আর আসার সুযোগ পেলনা। এবারে সিদ্ধান্তটা মারিয়াম নিজেই নিল। গান শেখার চেয়ে কুরআন শেখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।

তখন মারিয়াম ক্লাস ফোরে পড়ে। নিজের এই সিদ্ধান্তের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে পরে অনেক শুকরিয়া জানিয়েছে সে। সেই আরবী শিক্ষিকা আপুটির সাথে এখনো যোগাযোগ আছে মারিয়াম এর,মন খারাপ হলে আপুকে নক দেয়ার কথা টা প্রথমে মনে আসে।অনেক কিছু শেয়ার করে আপুর সাথে।

এই আপুর কাছ থেকেই প্রথম হেদায়েত ব্যাপারটা শুনেছিল মারিয়াম। তখন থেকে ধীরে ধীরে সালাত পড়া শুরু করে, হিজাব করার ইচ্ছা থাকলেও মায়ের ভয়ে কখনও মুখ ফুটে বলতে পারতো না অবশ্য।

আপু তাকে খুব ভালোবাসতেন। আপুর কাছ থেকে কত গল্প শুনত সে পর্দানশীল অন্যান্য আপুদের জীবনের। খুব অসহায় লাগতো নিজেকে।

ছোটবেলায় যেই নানীর কথায় নাচের স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছিল মারিয়ামকে, মারিয়াম ভেবেছিল নানীকে বললে হয়ত কোন লাভ হবে। অনেক আশা নিয়ে বলেছিল নানীকে,তিনি তো চাইলে মারিয়াম এর মাকে পর্দা করার ব্যাপারে বলতে পারেন। কিন্তু তিনি বলেন নি। বলেছিলেন মেয়ের বিয়ের পরে সেই দায়িত্ব মেয়ের জামাই এর, তার নয়। মারিয়াম তাও অনুরোধ করেছিল, “আচ্ছা আপনি যদি আম্মুকে একটা বোরখা গিফট করেন আম্মু কি পড়বেন না?”

নানী অবশ্য এই ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখান নি। নিজে পর্দা করেন, মানেন, অথচ মেয়েকে কেন করতে বলেন না — এই ব্যাপারটা মারিয়ামের মাথায় আসে না।

পরবর্তীতে এই নানীকে নিয়ে মারিয়ামকে কেবল হতাশই হতে হয়েছে। ক্লাস সিক্স এ যখন সে পড়ে, তখন বাংলা মিডিয়াম এর ইসলাম শিক্ষা বই এ তাহাজ্জুদ এর নামাজ এর কথা পড়েছিল। তখন থেকেই পড়া শুরু করে দিল। এই কথাটাই যখন নানী জানলেন আশ্চর্যজনক ভাবে খুশি হলেন না তিনি। বললেন, এত ছোট বয়সে এগুলো করাটা নাকি বেশি হয়ে যাচ্ছে।

কি জানি! মারিয়ামের ছোট মাথায় এত কিছু আসেনা। যেটা ভালো সেটা আবার খারাপ হবে কেমন করে?

এই নানীকে পীর ধরা সহ আরো অনেক বিদ’আত কাজ করতে দেখেছে মারিয়াম। বলার চেষ্টা করেছে, বোঝানোর চেষ্টা করেছে — কখনো কোনো লাভ হয়নি।

ক্লাস নাইন থেকে মারিয়াম একটা নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। স্কুলটি ইসলামিক স্কুল নামে পরিচিত ছিল। স্কুলড্রেসের সাথে হিজাব পরতে হতো। মারিয়ামের বেশ লাগতো সেটা।

একদিন অ্যাসেম্বেলি লাইন এ দাড়িয়ে আরবী ম্যাম বললেন, “তোমাদের না জেনেই একটা ওয়াদা করতে হবে, করবে?” সবার মতো মারিয়ামও হাত তুলল, করবে।

আর তারপর ম্যাম বললেন, “তোমরা আজ থেকে স্কুলের বাইরেও সবখানে এমন হিজাব পরে চলবে।” মারিয়ামের মনে যা খুশি লাগছিল, আর বলার মত না। যাক, এইবার আল্লাহ্‌ তাহলে সুযোগ দিলেন।

সেই ওয়াদার পালন কতজন করেছে সেই হিসেব মারিয়াম জানেনা। সে কেবল জানে,তার জবাবদিহিটা তার একার। মারিয়ামের ওয়াদার কাছে শেষে তার মাকেও হার মানতে হয়েছিল। মেয়ের সাথে হিজাব পড়া শুরু করেছিলেন তিনিও।

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। স্কুল থেকে কলেজ লাইফ, অনেক উত্থান পতন। ফ্রি মিক্সিং থেকে কোনোভাবেই যেন বেড়িয়ে আসতে পারছিলনা সে। খুব কাছের কিছু বান্ধবী রিলেশনশীপে জড়িয়ে পড়ায় তাদের সাথে সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায় তার। কারণ বিয়ের আগে এমন সম্পর্ক তো হারাম। কিন্তু এগুলো শুনে সেইসব বান্ধবীরা হাসতো।

যদিও যেমন সে বলেছিল এই সম্পর্ক টিকবেনা, তেমনই ভেঙ্গে যেত কিছুদিন পর। কিন্তু বন্ধুত্ব গুলো জোড়া লাগত না আর।

দিনে দিনে তার ফ্রেন্ড সার্কেল এভাবে কমে যাচ্ছিল।

এভাবে কলেজ থেকে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মারিয়াম। নাহ, কোনো ইসলামিক মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় না। হবেই বা কেন? মারিয়ামের পরিবার দেখে বুঝি আপনার অমন মনে হয়?

পুরোদমে অন্য আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত। ছেলে মেয়ে একসাথে সব। ফ্রি মিক্সিং আর ফ্রি মিক্সিং। আগেও তার কোনো দ্বীনদার ফ্রেন্ড ছিল না, এখানে এসেও অমন কাউকে পেল না। যেন কেমন এক শয়তানের চক্রে বাধা পড়ে যাচ্ছিল সে দিন দিন।

যতটা পারে ক্যাম্পাসের চেয়ে বাসায় থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতো সে। যতটা পারা যায় ফ্রি মিক্সিং কমানোর চেষ্টা করতো। নিজেকে খুব একা লাগতো তার। সবার সাথে সবার মত প্রাণ খুলে তাদের সব হারাম সম্পর্ক আর ওই সব গল্পে যোগ দিতে খুব বাধে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে কান্না ওঠে।

আর সব হিজাবি মেয়েদের ভীরে, একটা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে নিয়ে হাত ধরে ঘুরাঘুরি করার মত হারাম সব জিনিসগুলোকে মেনে নিতে পারেনা সে। সবার সাথে অনেকেই তাকে গুলিয়েও ফেলে। খুব খারাপ লাগে তখন,নিজেকে খেলো মনে হয়। সেকুলার সমাজে সে মিশতে পারেনা। প্রাক্টিসিং সমাজ তাকে খুব একটা মেনে নেয় না — তা সে যতই অনলাইনে অ্যারাবিক শিখার কোর্স করুক, কুরআন মেমোরাইজ করার চেষ্টা করুক অথবা শায়েখদের লেকচার শুনুক।

বাসা থেকে বিয়ের কথা বলা শুরু হতে থাকে। ছেলে হিসেবে বয়সে বড়, ম্যাচিওর, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ছেলেই সকলে খোঁজে।

অথচ রসুলুলুল্লাহ মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম তার মেয়ে ফাতিমার বিয়ে দিয়েছিলেন আলী(রা) এর সাথে। কতটা সামর্থ্যবান ছিলেন তিনি?

এসব কথা কাউকে বোঝানো যায়। না। মারিয়াম কেবল চায় যেন সে একজন প্রাক্টিসিং মুসলিম ছেলে বিয়ে করতে পারে, যে কি না প্রকৃতপক্ষেই তার দ্বীনের অর্ধেক হবে। দুনিয়া এবং আখিরাতের সঙ্গী হবে। কিন্তু এমন ছেলে সে কই পাবে? এমন ছেলেদের মায়েরা চান বোরখা পরা মেয়ে, এমনকি চান মেয়ের মা বোরখা পরুক, বাবার দাড়ি থাকুক। কিন্তু এমনটা মারিয়াম পাবে কই?

বাবাকে সালাতের কথা বলে বাজে রকমের ঝাড়িই খেয়েছে মারিয়াম। মা বোরখা পরেন না,কিন্তু হিজাব করেন, প্রাক্টিস করছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌।

কিন্তু তাতে কি?

কে বুঝবে?

ক্লাসের গাঁজা-সিগারেট খাওয়া, আরও দশটা হারাম কাজ করা ছেলেটারও নাকি কালো বোরখা পরা, হাত মোজা পরা সিনিয়র আপুকে দেখতে ভালো লাগে।

সমাজে মনে হয় ধার্মিক মেয়ে যাচাই করা সহজ, বিয়ের জন্য তেমন মেয়েই খোঁজে নামে ধার্মিক বা অধার্মিক এমনকি বকধার্মিক ছেলেটিও, কিন্তু তার জন্য নিজেকে প্রাক্টিসিং ছেলে বানাতে পারে কয়জন?

কিন্তু মারিয়াম হতাশ হয়নি,আল্লাহ্‌র কাছে দুয়া করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুয়ার চেয়ে শক্তিশালী আর কী আছে?

আপনারাও মারিয়ামদের জন্য দুয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাদের সত্যিকারের দ্বীনদার পাত্র মিলিয়ে দেন।

উত্থান-পতন

আফিয়া মুবাশ্বিরা মোমি

#রৌদ্রময়ী_ফিরে_আসার_গল্প

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88