যেভাবে বৌদ্ধ বাংলা রুপান্তরিত হল মুসলিম বাংলায়

একসময় বাংলার মেজরিটি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল। একটানা ৪ শত বছর বৌদ্ধরা বাংলা শাসন করেছিল, বৌদ্ধ শাসনামল পাল শাসনামল নামে পরিচিত। আজো বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বঙ্গে বৌদ্ধ শাসনামলের নানা নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এখনো বৌদ্ধদের পুরনো অনেক বিহারের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। বৌদ্ধরাই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় কিছু ধর্মীয় গান রচনা করেছিল যেগুলো চর্যাপদ নামে পরিচিত, চর্যাপদই হচ্ছে বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম নিদর্শন।

প্রশ্নহচ্ছে এতসব বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষজন গেল কোথায়? তারা যদি বাংলা ছেড়ে চলে যায় তাহলে কেন চলে গিয়েছে এবং কোথায় গিয়েছে? যদি বাংলাতেই থাকে তাহলে তারা এখন কোন ধর্মের অনুসারী?

৭৫০ খ্রিস্টাব্দে পাল বংশের প্রথম রাজা গোপালের মাধ্যমে বৌদ্ধদের শাসনামল শুরু হয় এবং বৌদ্ধদের শাসন ৪শ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরবর্তিতে দক্ষিন ভারত থেকে আগত সেন বংশের (ব্রাহ্মন) লোকেরা পালদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। দক্ষিন ভারতীয় সেন ব্রাহ্মনরা ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে। সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধদের একটা অংশ নেপালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহন করে। যে কারণে চর্যাপদ নেপাল থেকে আবিস্কৃত হয়।

বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে বৌদ্ধদের একটা অংশ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে বর্ণ প্রথার সর্বনিন্মে স্থান পায়। বৌদ্ধদের আরেকটি অংশ দিল্লির মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের শরণাপন্ন হয় এবং বৌদ্ধদের রক্ষায় বাংলায় মুসলিম সেনাবাহিনী পাঠানোর অনুরোধ করে। তিব্বতী বুদ্ধ ঐতিহাসিক কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রীর বিবরনী থেকে জানা যায় মগধ থেকে এক দল ভিক্ষু মির্জাপুরে গিয়ে বখতিয়ারের সংগে দেখা করে তাকে মগধকে মুক্ত করতে আবেদন করেন (Journal of the Varendra Research Society, Rajshahi, 1940)। বৌদ্ধদের অনুরোধে বখতিয়ার খিলজি তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন কে পরাজিত করে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।

বৌদ্ধগণ এতটা উৎপীড়িত হইয়াছিল যে তাহারা মুসলমানদের পূর্বকৃত শত অত্যাচার ভুলিয়া বিজয়ীগণ কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলন এবং মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় ভগবানের দানস্বরূপ মনে করিয়াছিল। শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ নামক অধ্যায়ে দেখা যায়-তাহারা (বৌদ্ধরা) মুসলমানদিগকে ভগবানের ও নানা দেবদেবীর অবতার মনে করিয়া তাহাদের কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলনে নিতান্ত আনন্দিত হইয়াছিল।….ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে সেনরাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙালি জাতির রীতিমত কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু, নব ব্রাহ্মণদিগের ঘোর অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়াছে (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-৫২৮)

মুসলিম শাসকদের উদারতা, বৌদ্ধদের প্রতি মুসলিমদের ভালো ব্যবহারের ফলে দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেলো’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্ম, পৃষ্ঠা ১৩১)। তবে মুসলমান হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি রাতারাতি হয়ে যায়নি, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে বৌদ্ধ-মুসলিম সংমিশ্রনের ফলে বৌদ্ধরা আস্তে আস্তে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।

বখতিয়ার খিলজি ছাড়াও পূর্ব থেকে বাংলার অন্যান্য মুসলিমরা নির্যাতিত বৌদ্ধদের পক্ষে অবস্থান নেন। বৌদ্ধরা বখতিয়ার খিলজি ও তার বাহিনীকে দু-বাহু বাড়িয়ে বরণ করে নেন।বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক আবদুস সাত্তার লিখেন; ”ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারণ মানুষ  উৎফুল্ল হয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল।হোসেন শাহের বেলায়ও একই কথা”

এই শাসনের বৈশিষ্ট ছিল বাংলায় স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে মুসলিম আরবদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠে। স্থানীয় ব্যবসা ছিল বৌদ্ধদের হাতে আর এই ব্যবসার সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সৃষ্টি করে দেন মুসলিম বনিকগন। ফলে বৌদ্ধদের সাথে মুসলিমদের একটা সুসম্পর্ক তৈরী হয়।

স্থানীয় বৌদ্ধদের সমর্থন না পেলে মুসলিমদের পক্ষে এত সহজে বাংলা বিজয় সম্ভব হতনা বলে অনেকে মনে করেন। বৌদ্ধদের দুর্দিনে মুসলিমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার ফলে বৌদ্ধরা মুসলিমদের সংস্পর্শে আসতে থাকে এবং ইসলাম দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। হিন্দু ধর্ম থেকেও অনেকে উচ্চ-নিম্ন বর্ণ বৈষম্যের কারণে ইসলামে আসতে থাকে।

কিন্তু উপনিবেশকালে পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিষ্ট এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদরা মিথ্যাচার করতে থাকে যে মুসলমানদের সাথে বৌদ্ধদের দ্বন্দ্বের কারনে বাংলা থেকে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। প্রফেসর Johan Elverskog তাঁর Buddhism and Islam on the Silk Road বইয়ে ভারতে বৌদ্ধ মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত এই মিথ্যাচার ও ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বৌদ্ধদের উপর মুসলিম সেনাপতি ও শাসকগন অত্যাচার করেছেন এই ধারণাকে তিনি নাকচ করে দেন।তিনি বলেন; “…the stereotypical image of Muslims as hostile towards Buddhists has been constructed in the West, and “reaffirmed” with the Taliban’s destruction of the giant Buddha statues in Bamiyan in 2001” (pp. 1–4). অর্থাৎ, বৌদ্ধদের সাথে মুসলমানদের শত্রুতার প্রচলিত ধারণা পশ্চিমে তৈরি হয় এবং এটা আরো প্রতিষ্ঠিত হয় তালেবান কর্তৃক ২০০১ সালে (আফগানিস্তানের বামিয়ানে) বিশাল বৌদ্ধমুর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে।

মূলত বাংলার মুসলিমদেরকে চারভাগে ভাগ করা যায়;

১. সমুদ্র পথে চিটাগাং দিয়ে আরব দেশ থেকে আগত দা’য়ী এবং ব্যবসায়ী,
২. তুরস্ক-ইরান-আফগানিস্তান এসব অঞ্চল থেকে স্থলপথে শাসন করার উদ্দ্যেশে বাংলায় নানা সময়ে মুসলিমদের আগমন,
৩. বৌদ্ধদের সাথে মুসলিমদের রাজনৈতিক সমঝোতা, সামাজিক সখ্যতা গড়ে উঠা এবং ইসলাম দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ.
৪. বর্ণ বৈষম্যের কারণে হিন্দু ধর্ম ত্যগ করে ইসলাম গ্রহন,

তবে এই চার ভাগের মধ্যে বাংলার মুসলমানদের বড় অংশই বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে (দেখুনঃ The Rise and Fall of Buddhism in South Asia, London, 2008)।

রেফারেন্সঃ

Baxter, Craig. 1998. Bangladesh: From a Nation to a State. Boulder, CO: Westview Press.

Chowdhury, M. Abdul Mu’min, The Rise and Fall of Buddhism in South Asia, London , 2008

Johan Elverskog, Buddhism and Islam on the Silk Road. Philadelphia: University of Pennsylvania Press, 2010

আবদুস সাত্তার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত),বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠাঃ২৭৫

সূত্র 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member