শুধু তোমাকে বলছি… (আর কাউকে বোলো না, প্লীজ!)

ঘটনা ১
“আপা, নামেন।”
চমকে রিকশাওয়ালার দিকে তাকালো মিলা। চলে এসেছে? এতো তাড়াতাড়ি? হবেও বা। বাসা থেকে বেরিয়েছে কেমন একটা ঘোরের মাঝে, রিকশাও ঠিক করেছে কিছু না বুঝেই।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পুরনো রঙ উঠে যাওয়া লোহার গেট ঠেলে বাসার উঠোনে এসে দাঁড়ালো মিলা। রোজিনা খালা কি আছেন বাসায়? একটা ফোন করে আসতেও মনে নেই। বহুদিন ধরে স্বামীর সাথে সমস্যা চলছে, কাউকে বলেনি, নিজের মাকেও না। কেই বা বুঝবে তাকে? আজ যখন অসহ্য হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে, তখন এই সহজ সরল মহিলার কথাই মনে এসেছে।

“এসো মা, এসো। তোমার চেহারা অমন হয়ে আছে কেন?”

“খালা, আমি কি আপনাকে কিছু কথা বলতে পারি? কিন্তু কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলবেন না, প্লীজ?”

চোখের পানি আর বাঁধ মানেনি। খালাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল মিলা। বলে ফেলল সব কথা। অনেকক্ষণ ধরে বুঝালেন মহিলা মিলাকে। বহুদিন পর যেন কেউ মিলাকে ভালবাসল

কবে এই মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছিলো যেন? মিলার মনে নেই। তার বাবা মায়ের পরিচিত, খুব ঘনিষ্ঠ। বিশ্বস্ত। তাই তো উনার কাছেই ও ছুটে এসেছে। ছোট্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিলা।

হাল্কা মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিল সেদিন মিলা। রোজিনা খালার দেয়া উপদেশগুলোও ভুলেনি। সত্যি বলতে তার সংসারটাও টিকে গিয়েছে।

একদিন সে আর তার স্বামী রাত করে বাসায় ফিরছিল। পথে স্বামীর এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধুটি খুব অবাক চোখে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কুশল পর্বের আগেই বলে বসলো, “যাক বাবা, তোরা একত্রে আছিস তাহলে এখনো?” অবাক হয়ে মিলার স্বামী প্রশ্ন করলেন “মানে?”

“না মানে ইয়ে ওই রোজিনা অ্যান্টি আছেন না? আরে ওই যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন? তিনি বলছিলেন যে মিলার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মিলা। শুনতে পায় না স্বামী প্রশ্ন করছেন রোজিনা অ্যান্টি ব্যাপারটা কিভাবে জানলো। শুনতে পায়না স্বামীর বন্ধু সেই মহিলার থেকে শোনা পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করছেন।

এক মূক অভিমানে স্তব্ধ হয়ে থাকে সাংসারিক বুদ্ধিতে কাঁচা মিলা। অতি বোকা মিলা।

ঘটনা ২
মেয়েটি কাঁদছিল। পাশে এসে বসলো তার বান্ধবী সোহানা।

“এই লাবনী, এই। কাঁদছিস কেন?”

আচ্ছা মেয়ে তো! কাঁদছে, অথচ বলবে না কী হয়েছে! “চল আমার বাসায় যাবি। অ্যান্টিকে কল করে বলে দে। বিকেলে পৌঁছে দিয়ে আসবো চল! একসাথে দুপুরে খাব, গল্প করব, দেখবি মন ভাল হয়ে গিয়েছে।”

সোহানাদের বাড়িটা খুব সুন্দর। ওর মা খুব আদর করেন লাবনীকে। সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচয়, কত এসেছে! দুপুরে খাওয়ার পর একথা সেকথা বলতে বলতে একসময় বলেই ফেলল লাবনী তার সমস্যার কথা। একজনকে ভালবাসে। তার সাথে বাবা মা বিয়ে দিবেন না। সোহানার জন্য এসব কোনও ব্যাপার না– ও কোনদিনও সিরিয়াস না এসব নিয়ে। আর কি অদ্ভুত মেয়েটা, হাসি ঠাট্টা করে লাবনীরও মনের দুঃখ কখন কাটিয়ে দিল লাবনী টেরও পায়নি।

বাসায় ফেরার সময় সোহানার হাত ধরে বলল, “কাউকে বলিস না রে। আমাদের ফ্রেন্ডদেরও না”

……………………………………..

আজ লাবনীর বিয়ে। না, বাবা মা কে কষ্ট দিতে পারেনি সে। চুপচাপ বসেছিল। বান্ধবীরাও এসেছে সবাই। তাদের হৈ চৈ ওর কানে যেন প্রবেশ করতে পারছে না। এমন সময় কে যেন ওর হাত চেপে ধরল। চমকে তাকিয়ে দেখে রিতার আম্মা। রিতাও সোহানির মতই ওর বাল্য বান্ধবী। মহিলা ফিস ফিস করে বললেন, “মা, এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত বুঝে শুনে নিয়েছ তো?”

অ্যান্টি ভুল কিছুই বলেননি। তবু লাবনীর মনেহল কে যেন তার অন্তরে ছুরি চালিয়ে দিল। সোহানা? হ্যাঁ, সোহানাই। তাকে ছাড়া তো আর কাউকে বলেনি সে?

“এই কি করছিস সব মেক আপ নষ্ট হয়ে যাবে যে!” আরেকবার চমকে ওঠে লাবনী। এবার তার প্রানপ্রিয় বান্ধবী সোহানার স্পষ্ট কথায়। তাই তো, সে নিজেই বুঝতে পারেনি এতক্ষন ধরে যে সে কাঁদছে!

বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদছে!

ঘটনা ৩
অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়ে মাত্র রুমা ল্যাপটপটা অন করে বসেছে। এমন সময় ফোন। “আপা, আমি ঊর্মি।” কে? ও আচ্ছা, ওই যে সেদিন রুমাদের অফিসে এসেছিলো, তার এক জুনিয়রের বউ।

“আপা শুনছেন? আমি একটু বিপদে পড়েছি, আপনাকে সেদিন দেখেই বড় ভাল লেগেছিল, বড় আপন মনে হয়েছিল, তাই আপনাকেই বলছি। কাউকে বলবেন না প্লীজ। আপা জানেন, আমার স্বামী…”

মেয়েটির সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে একটু চা করতে রান্না ঘরে গেল রুমা। মাথাটা ধরে গিয়েছে। না, মেয়েটার কথায় না। এমন করে মনের কথা অনেকেই বলে থাকে তাকে। কেন টা সে নিজেও জানেনা। মাথা ধরেছে একথা ভেবে যে আজকাল মেয়েগুলো এত বোকা হয় কেন? চিনে না, জানে না এমন মানুষকেও আপন ভেবে মনের কথা সব বলে দেয়। রুমা জানে রুমা আর কাউকে বলবে না। কিন্তু তার জায়গায় অন্য কেউ হলে?

চা খেতে খেতে আবার একই প্রশ্ন করলো নিজেকে রুমা। মেয়েগুলো এত বোকা কেন?

———————————————————————————————————-

উপরের ঘটনা গুলো গল্পাকারে লিখলেও এসবই বাস্তব ঘটনা, বিভিন্ন সময়ে এমনটা হয়ে থাকে, হতে দেখেছি অথবা এমনটা হওয়ার দরুন কাউকে কষ্ট পেতে দেখেছি। সাধারণত যারা নিজেরা ভালো, তারাই এসমস্ত কষ্ট গুলো পায়। কারণ তারা নিজেরাও অপরের মাঝে ভালটাই দেখতে পায়। তারা জানে বিশ্বাস মানুষই মানুষকে করে, আর মানুষই মানুষের বিশ্বাস রাখে। তারা জানে কেউ কাউকে কথা দিলে সে কথা ভাঙ্গা যায়না। নিজেরা প্রাণ দিয়ে হলেও নিজেদের দেয়া কথা রাখে বলেই অন্যের দেয়া কথাকেও প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে। এমন ভালো মানুষ হয়ে জন্মানোটা বর্তমান জগতে আসলে ভালোত্ব না, রীতিমত পাপ। আর হ্যাঁ, সেই পাপের মাসুল তাদের দিতে হয় নিজেদের অন্তরের রক্তক্ষরন দিয়ে।

আমার সেই সব পাপী বোনদের বলছি। যারা মানুষকে বিশ্বাস করে কিছু বলার মত পাপটা করেছ অথবা করতে চলেছ। একটা কথা কি জানো আপু, সব মানুষই মানুষ। মানবিক দুর্বলতা সবারই থাকে। এই যে গল্পে যাদের কথা লিখেছি, এরাও কিন্তু কেউই পুরোপুরি খারাপ না। কিন্তু তাদের এমন কিছু দুর্বলতা আছে যা অপরের জন্য ক্ষতিকর। হয়ত তারা নিজেরাও তা জানেনা। তাই আমি বলি কি, এই পৃথিবীতে মানুষকে ভালবাসবে। তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখবে। বিশ্বাসও করবে। শুধু নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বাস করে বসবে না। কারণ হয়ত কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে তারা ভুলে যাবে তোমাকে দেয়া কথা। ভুলে যাবে কথাটি ছড়ালে তোমার ক্ষতি হতে পারে। হয়ত সবাই তারা খুব ভালো। তবু শয়তান হয়ত তাদেরকে ভুলিয়ে দিবে। তুমি তো জানো, বোন, যে শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু, জানো না? একজন মানুষ যত ভালই হোক, মনে রাখবে যে সে তারপরও একজন মানুষই। মানুষটা খুব ধার্মিক হতে পারে, খুব পরিচিত বান্ধবী হতে পারে— তবুও সেও মানুষ। তাই এমন কথা কাউকে বলবে না যা কোনও কারণে পাঁচ কান হলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আর যদি খুব বলতে ইচ্ছা করে, নিজের মা কে বলবে, বোন কে বলবে। তাঁরা যদি বকেনও, তবু তাঁদের কাছেই তুমি সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁরা যে তোমাকে “তুমি” হিসেবে দেখেন না। তাঁরা তোমাকে দেখেন তাঁদেরই এক অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে!

আর হ্যাঁ। সবচেয়ে মজার কথাটা তো বলিইনি। তুমি কি জান, এমন একজন বন্ধু আছেন যাকে কিছু বলতে তোমার তাঁকে খুঁজতে হবে না, তুমি বললেই তিনি শুনবেন? তুমি কি জানো, তোমার বলতেও হবে না, তোমার চোখের প্রতিটা পানির হিসেব তিনি নিজেই রাখেন? তুমি কি জানো, এমন একজন আছেন যিনি তোমার দোষ অপরকে বলে বেড়াবেন না? তিনি যে তোমার প্রতিটা কথা শোনার জন্য সদা প্রস্তুত, তা কি তুমি জানো?

এত বিশ্বস্ত, এত আপন, এত কাছের তোমার সেই রব কে ফেলে আর কার কাছে যাবে তুমি ভালবাসা খুঁজতে, খুঁজতে আশ্রয়? আর কেনই বা যাবে বোন?

বোনেরা আমার, আমাদের জন্য আমাদের রব আছেন। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা যেন তাঁর কাছেই আমাদের অন্তরের প্রশান্তি খুঁজি। তাঁর সৃষ্টির কাছে না, যারা নিজেরাই তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থী। নিজেদের ভুলে নিজেদের যেন আমরা অসম্মান করে না বসি। আমাদের সম্মানটা যে আমাদের কাছে আমাদের জীবনের চেয়েও দামী!

আমীন!

রচনাঃ নায়লা নুজহাত

উৎসঃ কুরআনের আলো

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88