যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ (দ্বিতীয় পর্ব)

বিভিন্ন প্রকার যাকাতের বিস্তারিত বর্ণনা

প্রথম: অলঙ্কারের যাকাত

অলঙ্কার দু’প্রকার:

প্রথম প্রকার: দু’টি নগদ মুদ্রা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপা। স্বর্ণ ও রূপার যাকাত সম্পর্কে আহলে ইলমগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দেখতে হবে: স্বর্ণ-রূপা সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার জন্য, না সঞ্চয় করে রাখার জন্য, না ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজের জন্য। অধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যে উদ্দেশ্যেই তা সংগ্রহ করুক। কারণ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দলীল সবপ্রকার স্বর্ণ-রূপাকে শামিল করে, কোনো প্রকার স্বর্ণ-রূপা যাকাত থেকে বাদ দেওয়া হয় নি। তাই বলে যারা বলেন ব্যবহার করার স্বর্ণ-রূপার ওপর যাকাত ফরয নয়, তাদের কথাকে মূল্যহীন জ্ঞান করছি না, যেহেতু এটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ মাসআলা, তাতে দ্বিমত করার সুযোগ আছে।

জ্ঞাতব্য: নারীর মালিকানাধীন স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি তার নিকট যাকাত দেওয়ার অর্থ না থাকে, যাকাত পরিমাণ অলঙ্কার বিক্রি যাকাত দিবে। কেউ যদি তাকে যাকাতের ক্ষেত্রে সাহায্য করে, যেমন স্বামী বা নিকট আত্মীয় তবে তাতে কোনোও সমস্যা নেই।

দ্বিতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রূপা ব্যতীত অন্যান্য বস্তু যেমন হীরা, মুক্তা, ইয়াকুত, মোতি, মুক্তোদানা, গোমেদ-পীতবর্ণ মণিবিশেষ ইত্যাদি বস্তুর ভেতর যাকাত ওয়াজিব হয় না; তার মূল্য যাই হোক, তবে ব্যবসার জন্য হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে।

স্বর্ণ ও রূপার যাকাতের নিসাব

স্বর্ণের নিসাব: স্বর্ণের নিসাব বিশ দিরহাম স্বর্ণ, যা ওজন করলে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ হয়। কারও মালিকানাধীন যদি ৮৫ গ্রাম বা ততোধিক স্বর্ণ থাকে, ক্যারেট যাই হোক, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যাকাতের পরিমাণ এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট স্বর্ণের ২.৫ পার্সেন্ট।

যাকাত দেওয়ার নিয়ম: ব্যক্তির মালিকানায় যে ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে সেই ক্যারেটের একগ্রাম স্বর্ণের বাজার দর জানবে প্রথম। যদি একাধিক ক্যারেটের স্বর্ণ থাকে, যে ক্যারেট স্বর্ণ বেশি আছে তার বাজার দর জানবে, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে তার নিকট যে ক’গ্রাম স্বর্ণ রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে পূরণ দিবে। এভাবে স্বর্ণের গ্রামকে মুদ্রায় পরিণত করবে, অতঃপর ক্যালকুলেটর দিয়ে মোট মূল্য থেকে ২.৫% বের করবে, যে অংক আসবে তাই স্বর্ণের যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ২১ ক্যারেট ১০০ গ্রাম স্বর্ণের মালিক, সে তার যাকাত বের করার জন্য প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে, যদি একগ্রাম স্বর্ণের দাম হয় ১০,০০০ টাকা, যাকাতের হিসেব হবে নিম্নরূপ: ১০০ (গ্রাম-স্বর্ণ)* ১০,০০০ (টাকা, যা একগ্রাম স্বর্ণের মূল্য)* ২.৫% (যাকাত) অর্থাৎ ১০০* ১০,০০০* ২.৫%=২৫০০০ টাকা।

রূপার নিসাব: ২০০ দিরহাম রূপা, যা ওজন করলে ৫৯৫ গ্রাম হয়। কারও মালিকানায় যদি ২০০ দিরহাম বা তার চেয়ে বেশি রূপা থাকে এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তবেই তাতে যাকাত ফরয হবে। যাকাতের পরিমাণ: এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট রূপার ২.৫%।

যাকাত বের করার নিয়ম: যে ক্যারেট রূপা তার কাছে রয়েছে, প্রথম তার বাজার দর জানবে, আর যদি একাধিক ক্যারেটের রূপা থাকে, যে ক্যারেট রূপা বেশি রয়েছে তার বাজার দর জানবে। অতঃপর যত গ্রাম রূপা তার মালিকানায় রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে একগ্রাম রূপার বাজার দরকে গুণ দিবে, গুণফল থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে, যে অংক বের হবে সেটি ৫৯৫ গ্রাম রূপার যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ৬০০ গ্রাম রূপার মালিক, সে যখন তার যাকাত বের করার ইচ্ছা করবে প্রথম একগ্রাম ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। যদি মনে করি একগ্রাম রূপার মূল্য ১০০ টাকা, নিম্নের নিয়মে যাকাত বের করবে: ৬০০ (গ্রাম-রূপা)* ১০০ (টাকা, যা একগ্রাম-রূপার মূল্য)* ২.৫% = ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ একগ্রাম রূপার মূল্য যদি হয় ১০০ টাকা, ৬০০ গ্রাম রূপার যাকাত আসবে ১৫০০ টাকা।

জ্ঞাতব্য: স্বর্ণ-রূপা দ্বারা উদ্দেশ্য খালিস স্বর্ণ-রূপা, সেটি মুদ্রা হতে পারে, যেমন স্বর্ণের জুনাই বা পরিশোধিত স্বর্ণও হতে পারে, যা দিয়ে এখনো গহনা তৈরি করা হয় নি। অনুরূপ আকরিক অর্থাৎ অশোধিত স্বর্ণ-রূপার বিধান।

মাসআলা: কেউ স্বর্ণ-রূপা দু’টি বস্তুর মালিক, একটিও নিসাব বরাবর নয়, সে কি স্বর্ণ-রূপা জমা করবে? অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপার বাজার দর যোগ করে যদি দেখে শুধু স্বর্ণ বা শুধু রূপার নিসাব বরাবর হয়, তার কি যাকাত দেওয়া ওয়াজিব?

আহলে ইলমদের বিশুদ্ধ মত মোতাবেক এই অবস্থায় স্বর্ণের সাথে রূপা যোগ করা জরুরি নয়, স্বর্ণ বা রূপা কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না স্বতন্ত্রভাবে স্বর্ণ বা রূপা যাকাতের নিসাব বরাবর হবে। কেননা বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, স্বর্ণ ও রূপা স্বতন্ত্র দু’টি বস্তু, একটির সাথে অপরটি যোগ করে নিসাব পূর্ণ করার কোনও দলীল নেই।

এ কথা নগদ অর্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অর্থাৎ কেউ যদি নগদ অর্থের মালিক হয়, যাকাতের নিসাব পূর্ণ করার জন্য স্বর্ণ বা রূপা বা ব্যবসায়ী পণ্যের সাথে নগদ অর্থ যোগ করা জরুরি। কারণ, যাকাতের সম্পদ বলতে যা বুঝানো হয়, অলঙ্কার, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্য তার অন্তর্ভুক্ত। এ কথার অর্থ স্বর্ণের যাকাত টাকা দিয়ে, টাকার যাকাত স্বর্ণ দিয়ে আদায় করা বৈধ। কারণ, একটি অপরটির প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব, কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও স্বর্ণ থাকে, একটির সাথে অপরটি যোগ করা জরুরি। অর্থাৎ স্বর্ণকে টাকার অংকে নিয়ে আসবে, অতঃপর নগদ অর্থ ও স্বর্ণের মূল্য হিসেব করবে, যদি নিসাব পরিমাণ হয় উভয়ের যাকাত দিবে, অর্থাৎ যৌথভাবে স্বর্ণ ও নগদ অর্থের যাকাত দিবে, যদি তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়। অনুরূপ কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও রূপা থাকে অথবা নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রূপা থাকে, সে স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ যোগ করে যাকাত দিবে, তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখবে যে, এক বস্তু থেকে একই বছর দু’বার যাকাত গ্রহণ করা যাবে না।

দ্বিতীয়: ব্যাংক নোটের যাকাত

ব্যাংক নোট যেমন ডলার, জুনাই, রিয়াল ও অন্যান্য মুদ্রা, যা নগদ অর্থ হিসেবে পরিচিত। অনুরূপ অর্থের বিভিন্ন দলীল, যেমন চেক, বিল, বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র, যার বৈষয়িক মূল্য রয়েছে।

জ্ঞাতব্য যে, ব্যাংক নোট ও চেক মূলত তার মূল্যের দলীলস্বরূপ, অতএব, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। প্রতি হাজারে পঁচিশ টাকা যাকাত আসবে।

আরেকটি জিজ্ঞাসা, টাকার নিসাবের মানদণ্ড কি, স্বর্ণ, না-রূপার মূল্য?

উত্তর: রূপার নিসাবের মূল্যকে টাকার নিসাবের মানদণ্ড করাই উত্তম, অর্থাৎ ব্যাংক নোট, চেক ও অন্যান্য ডকুমেন্টের মূল্য যদি ৫৯৫ গ্রাম রূপার মূল্য বরাবর হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এভাবে যাকাত দেওয়া উত্তম কয়েকটি কারণে:

প্রথমত: এতে রয়েছে সতর্কতা ও দায়-মুক্তি, কেননা হতে পারে আল্লাহর নিকট রূপার মূল্যের ভিত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। কারণ, নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্য নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অপেক্ষা অনেক কম।

দ্বিতীয়ত: নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্যকে টাকার যাকাতের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে গরীবদের উপকার হয়। কারণ স্বর্ণ অপেক্ষা রূপার মূল্য কম। তাই রূপার নিসাবে যে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, স্বর্ণের নিসাবে সে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয় না। অতএব, রূপার নিসাবে যাকাত দানকারীর সংখ্যা বাড়বে, ফলে গরীবরা উপকৃত হবে। তবুও আমরা তাদেরকে তিরস্কার করি না, যারা দ্বিতীয় মতকে গ্রহণ করে স্বর্ণের মূল্য হিসেব করে যাকাত দিবেন। কারণ, মাসআলাটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ।

অতএব, মালিক যদি রূপার নিসাবের ভিত্তিতে যাকাত দেয়, প্রথম রূপার বাজার দর জানবে। উদাহরণত ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। কারণ, ৮০ ক্যারেট রূপা মানুষের মাঝে প্রচলিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর এক গ্রাম রূপার মূল্যকে ৫৯৫ দিয়ে গুণ দিবে, যে অংক আসবে সেটি রূপার নিসাবের মূল্য। এবার দেখবে রূপার নিসাবের মূল্য ও যাকাত দানকারীর স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ বরাবর কি না, যদি বরাবর বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ প্রত্যেক হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যা যাকাত দানকারীর মোট সম্পদের ২.৫%। উদাহরণত কেউ ১০০০০০ এক লক্ষ টাকার মালিক, তার যাকাত হবে: ১০০০০০* ২.৫%= ২৫০০ টাকা। যদি রূপার মূল্যকে মানদণ্ড মানা হয়।

আর যদি স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থের যাকাত বের করার সময় দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেক স্বর্ণের মূল্যকে যাকাতের মানদণ্ড মানা হয়, প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে। কারণ, এই ক্যারেট স্বর্ণ সবার নিকট পরিচিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে ৮৫ দিয়ে গুণ দিবে, গুণফল ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের বাজার মূল্য, যা স্বর্ণের নিসাব। যদি কারও স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ এই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেকও যাকাত ওয়াজিব হবে, অর্থাৎ প্রতি হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যেমন পূর্বে বলেছি।

ঋণের যাকাত:

আলিমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন যে, মানুষের নিকট যার যাকাতের নিসাব পরিমাণ ঋণ বা পাওনা আছে এবং সে ঋণের ওপর হিজরী এক বছরও পূর্ণ হয়েছে, তার যাকাত বের করা কি ওয়াজিব?

আলিমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ঋণের ওপর যাকাত নেই, ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত বা অনিশ্চিত যাই হোক। ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ স্বীকার করে, ভবিষ্যতে অস্বীকার করবে না এবং তার থেকে উসুল করাও সম্ভব। ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ অস্বীকার করে অথবা গরীব-ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য তার নেই অথবা ঋণ নিয়ে টালবাহানাকারী। এসব ক্ষেত্রে যাকাত নেই। কারণ, ঋণ তার পূর্ণ আয়ত্তে নেই, সে তাতে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে না, যেহেতু তার কাছে নেই, তবুও যারা বলেন, ঋণের ওপর যাকাত ফরয তাদের মতকে মূল্যহীন বলি না।

কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

১. মানুষের নিকট যাদের বকেয়া রয়েছে, সেই বকেয়ার সাথে যুক্ত হবে বকেয়া মাহর। অর্থাৎ বকেয়া মাহর স্বামীর ওপর স্ত্রীর ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপ ঋণ গণ্য হবে কাস্টমারের নিকট থাকা দোকানির অবশিষ্ট কিস্তি। এতদ ভিন্ন অন্যান্য ঋণের ওপরও যাকাত নেই, যতক্ষণ না মালিক তা হস্তগত করবে। হাতে পাওয়ার পর থেকে যখন এক বছর পূর্ণ হবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ মত। অনুরূপ কারও যদি সম্পদ থাকে, আর সে সম্পদ চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ, তার ওপর মালিকের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেই, যদি সম্পদ ফেরত পায় তবুও তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ওপর এক বছর পূর্ণ হবে। এটিই বিশুদ্ধ মত, যেমন ঋণ ফেরত পাওয়ার মাসআলায় বলেছি।

২. ঋণী ব্যক্তির মাসআলা: অর্থাৎ যার নিকট মানুষের ঋণ আছে, তার ঋণের ওপর যদি এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত দিবে কি না? উত্তর: হ্যাঁ, যাকাত দিবে, তবে ঋণের সম্পদ তার আয়ত্তে ও কর্তৃত্বে থাকা শর্ত।

৩. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর যদি যাকাত ফরয হয়, যেমন সে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রূপা অথবা ব্যবসায়ী পণ্যের মালিক, সে যাকাত দিবে, ঋণের কারণে তার যাকাত মওকুফ হবে না। এটি আলিমদের বিশুদ্ধতম মত। সে তার নিজের সম্পদের সাথে (যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে), ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ করবে, অতঃপর সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে। কারণ, তার আয়ত্তে থাকা সকল সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব, যার অন্তর্ভুক্ত ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থও।

৪. যদি যাকাত বের করার সময় ঋণ পরিশোধ করার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে আসে, আগে ঋণ পরিশোধ করবে। ঋণ পরিশোধ করার পর যদি যাকাতের নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপর যাকাত নেই, কারণ নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। অনুরূপ কারও ওপর মান্নত ওয়াজিব অথবা কাফফারা ওয়াজিব, যেমন যিহার বা কসমের কাফফারা। যদি কাফফারা আদায় বা মান্নত পুরো করার পর নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপরও যাকাত নেই, যদিও তার ওপর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। পুনরায় যখন নিসাব পরিমাণ হবে সঙ্গে-সঙ্গে যাকাত দিবে, হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করবে না। কারণ, আগেই তাতে বছর পূর্ণ হয়েছে। আহলে ইলমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৫. একটি প্রশ্ন: কোনও ফকিরের নিকট কারও পাওনা আছে, সে পাওনা মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে কি?

আলিমগণ এ মাসআলায় দু’টি মত পোষণ করেছেন:

এক. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে না।

দুই. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ অভিমত। হাসান বসরি রহ. এতে একটি শর্ত দিয়েছেন: “যে ঋণ সে মওকুফ করবে, তার থেকে কর্জ নেওয়া ঋণ হতে হবে”। দ্বিতীয়ত ঋণী ব্যক্তির যাকাতের হকদার হওয়া জরুরি। যাকাতের হকদার কারা সামনে তার বর্ণনা আসছে। অতএব, ব্যবসায়ী যদি কাস্টমারের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করে তবে তাতে যাকাত আদায় হবে না।

৬. যদি পাওনাদার ঋণগ্রস্ত ফকীরকে এই শর্তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা দিয়ে সে তার পাওনা পরিশোধ করবে, তাহলে কারও মতেই যাকাত আদায় হবে না। কারণ সে ফেরত বা রিটার্ন করার শর্তারোপ করেছে। যদি ঋণগ্রস্ত নিয়ত করে যাকাতের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ দিবে, আর যাকাত দানকারী এই নিয়তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা নিয়ে সে আমার ঋণ পরিশোধ করবে, তবে কেউ মুখে প্রকাশ করেনি, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে এবং ঋণগ্রস্ত ফকীরও ঋণ থেকে মুক্ত হবে, যদি ঋণ পরিশোধ করে।

৭. যদি বাড়ি নির্মাণ অথবা হজ অথবা বিবাহ অথবা কোনও উদ্দেশ্যে টাকা জমা করে, যা নিসাব পরিমাণ এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।

৮. ‘ঋণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কারও নিকট সাব্যস্ত পাওনা, যেমন কর্জ করা ঋণ, আসবাব-পত্র ক্রয় করার কিস্তি, বকেয়া ভাড়া, স্বামীর জিম্মায় স্ত্রীর মাহর ও স্ত্রীর জিম্মায় স্বামী থেকে খোলা করার বিনিময় (অর্থ বা কোনও কিছুর বিনিময়ে স্বামী থেকে স্ত্রীর বিচ্ছেদ গ্রহণকে খোলা বলা হয়)। এসব ক্ষেত্রে পাওনাদারের ওপর যাকাত নেই। আলিমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৯. যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, মালিক এখনো যার যাকাত আদায় করেনি, ইতোমধ্যে যদি নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, যেমন চুরি বা ধ্বংস হয় অথবা পুড়ে যায় অথবা পশু মরে নিসাব থেকে কমে যায় অথবা যে জন্যই হোক নিসাব থেকে সম্পদ হ্রাস হয়, এই অবস্থায় যাকাত দিতে হবে কিনা আহলে ইলমগণ দ্বিমত করেছেন। কেউ বলেছেন: যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কেউ বলেছেন: সম্পদ হ্রাসের ক্ষেত্রে যদি মালিকের সীমালঙ্ঘন অথবা অবহেলা দায়ী না হয় যাকাত দেওয়া ওয়াজিব নয়।

দু’টি মত থেকে প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ, সম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে মালিক দায়ী হোক বা না-হোক, যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কারণ, যাকাত আল্লাহর হক ও একটি ঋণ, নিসাবের ওপর এক বছর পূর্ণ হওয়ার সাথেই মালিকের ওপর আল্লাহর হক সাব্যস্ত হয়ে গেছে, যা আদায় করা ব্যতীত মওকুফ হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«فدَيْن اللهِ أحَقُّ أنْ يُقضَى».

“আল্লাহর ঋণ আদায় করার দাবি বেশি”।[1]

১০. যদি কেউ এক প্রকার সম্পদ একই শ্রেণির দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ দ্বারা বিনিময় করে, যেমন ২১ ক্যারেট স্বর্ণ ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দ্বারা বিনিময় করে অথবা টাকাকে ডলার করে অথবা পণ্য দিয়ে স্বর্ণ কিনে কিংবা স্বর্ণ দিয়ে পণ্য কিনে, এই অবস্থায় আগের পণ্য বা স্বর্ণের হিজরী বছর অব্যাহত থাকবে, বিনিময় করার কারণে বছর ভাঙ্গবে না। আর যদি এক শ্রেণির সম্পদ আরেক শ্রেণির সম্পদ দিয়ে বিনিময় করে, তাহলে আগের সম্পদের বছর অব্যাহত থাকবে না, নতুন সম্পদের জন্য নতুন বছর শুরু হবে। যেমন, কেউ মেষ বা বকরির মালিক, সে যদি এক জাতের মেষ বা বকরি দিয়ে আরেক জাতের মেষ বা বকরি বিনিময় করে, যার মূল্য নিসাব বরাবর বা তার চেয়ে বেশি, তাহলে পূর্বের বছর চলমান থাকবে। আর যদি বকরি বা মেষ দ্বারা গরু বা মহিষ বিনিময় করে, তখন পূর্বের বছর অব্যাহত থাকবে না, বরং গরু বা মহিষ থেকে নতুন বছর শুরু হবে।

এই নীতি থেকে ব্যবসায়ী পণ্য বাদ যাবে, সামনে তার আলোচনা আসছে। ব্যবসার এক পণ্য অপর পণ্য দিয়ে বিনিময় করলে বছর অব্যাহত থাকবে। যদি পূর্বের পণ্যের ব্যবসা ত্যাগ করে নতুন পণ্যের ব্যবসা আরম্ভ করে, তবুও বিশুদ্ধ মত মোতাবেক বছর অব্যাহত থাকবে। কারণ, ব্যবসার উদ্দেশ্য পণ্য বিনিময় করে সম্পদ বৃদ্ধি করা নির্দিষ্ট পণ্য মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।

আরেকটি জ্ঞাতব্য, স্বর্ণ ও রূপা দু’জাতের দু’টি মুদ্রা গণ্য করা হয়। আলিমদের বিশুদ্ধ মত এটি। অতএব, বছরের মাঝে কেউ যদি স্বর্ণ দিয়ে রূপা খরিদ করে অথবা রূপা দিয়ে স্বর্ণ খরিদ করে বছর ভেঙ্গে যাবে এবং বিনিময় করার পর থেকে নতুন বছর শুরু করবে।

এক পণ্য দিয়ে অপর পণ্য বিনিময় করার উদ্দেশ্য যদি হয় যাকাত থেকে অব্যাহতি ও যাকাত ফাঁকি দেওয়া, তবে সে পাপী ও শাস্তির উপযুক্ত হবে।

(লেখকঃ রামি হানাফী মাহমুদ)

চলবে……

তথ্যসূত্রঃ

[1] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88