নেতৃত্বের মোহ (দ্বিতীয় পর্ব)

ক্ষমতা প্রকাশের ক্ষেত্র (مظاهر حب الرئاسة)   :

শাসন ক্ষমতা যাহির করার নানাক্ষেত্র রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম।

১. আল্লাহর সার্বভৌম ও সার্বিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা : ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার, তাঁর সঙ্গে শরীক করা, নিজেকে তাঁর সমকক্ষ দাবী করা কিংবা তাঁকে বাদ দিয়ে নিজেকে মা‘বূদ আখ্যা দেওয়া সবচেয়ে বড় পাপ। শেষোক্ত দু’টি পাপও মানুষ করেছে। মিশররাজ ফেরাঊন আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেকে মা‘বূদ বা উপাস্য বলে দাবী করেছিল। সে বলেছিল,مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَهٍ غَيْرِيْ ‘হে আমার পারিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য আছে বলে তো আমি জানি না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)। সে আরো বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى ‘আমিই হচ্ছি তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রভু’ (নাযি‘আত ৭৯/২৪)

সে মূসা (আঃ)-কে বলেছিল,لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهاً غَيْرِيْ لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِيْنَ ‘যদি তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মা‘বূদ হিসাবে গ্রহণ কর তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাকে জেলে ভরব’ (শু‘আরা ২৬/২৯)। তার জাতি এ কথা হাল্কাভাবে নিয়েছিল এবং তার প্রভুত্ব মেনে নিয়েছিল। ইবলীস শয়তানও চায় যে, মানুষ তার ইবাদত করুক এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার কথা মেনে চলুক; আনুগত্য ও ইবাদত কেবল সেই লাভ করুক, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য মোটেও না করা হোক। ফেরা‘ঊন ও ইবলীসের এহেন প্রবণতা বদমায়েশি ও মূর্খতার চূড়ান্ত পর্যায়ভুক্ত। সকল মানুষ ও জিনের অন্তরে এরূপ দাবীর মানসিকতা কিছু না কিছু বিরাজ করে। বান্দা আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য ও হেদায়াত না পেলে তার পক্ষে ফেরাঊন ও ইবলীসের মত একটা কিছু করে ফেলা অসম্ভব নয়।[1]

২. আমলের মাঝে একনিষ্ঠতার অভাব দেখা দেয়া : রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রার্থীর চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় আসীন হওয়া এবং বরাবরের মতো তা ধরে রাখা। ফলে তার মিত্রতা-শত্রুতা, দেয়া-না দেয়া, ঘৃণা-ভালবাসা সবকিছুই ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এমতাবস্থায় তার কোন কাজে ইখলাছ বা সদিচ্ছা থাকে না। ফলে সে ধ্বংসশীলদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়ে।

৩. ক্ষমতা না পেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা : ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ক্ষমতা না পেলে কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দানে সে কৃপণতা করে। বরং অনেক সময় সে অপর পক্ষ যাতে ব্যর্থ হয় সে আশায় তাকে এড়িয়ে চলে। ব্যর্থ হ’লে সে তার স্থলে নেতৃত্ব দিতে পারবে সেজন্য।

৪. লোকের দোষ আলোচনা এবং অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করা : ক্ষমতাপ্রিয় প্রত্যেক ব্যক্তিই অন্যদের দোষ-ত্রুটি সমালোচনা করতে খুব ভালবাসে। সে বুঝাতে চায় পূর্ণ যোগ্যতা কেবল তার মধ্যেই আছে। তার সামনে কেউ অন্যের গুণগান করুক- তা সে মোটেও পসন্দ করে না। যে ক্ষমতার প্রেমে মাতোয়ারা হয় তার নিকট থেকে সৎ গুণগুলো বিদায় নেয়।

৫. দ্বীনদারী ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার থেকে কেউ শ্রেয় আছে বলে সে মানতে নারায : সে অন্যদের যোগ্যতা ও মাহাত্ম্য লুকিয়ে রাখে, তাদের তথ্যাদি জানতে দিতে চায় না- যাতে মানুষ তাদের খোঁজ না পায়। কেননা তারা তাদের কথা জানতে পারলে তাকে ছেড়ে ওদের কাছে চলে যাবে। আবার পারস্পরিক তুলনা করে হয়তো তার মর্যাদা কম গণ্য করতে পারে।

৬. ক্ষমতা হারিয়ে গেলে কিংবা কেড়ে নেওয়া হ’লে আফসোস করা : ক্ষমতাই যার ধ্যান ও জ্ঞান তার হাত থেকে যখন ক্ষমতা অন্যের হাতে চলে যায়, তখন তার মন দুঃখ-বেদনায় কাতরাতে থাকে এবং আফসোস-অনুশোচনায় জ্বলে-পুড়ে যায়।

৭. জনগণের সামনে দাম্ভিকতা প্রকাশ এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা : মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে একটি কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (তিনি তাঁকে এক এলাকার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন।) আমি দায়িত্ব পালন শেষে মদীনায় ফিরে এলে তিনি বললেন, মিকদাদ, সরকারী দায়িত্ব কেমন অনুভব করলে? আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! আমার কেবলই মনে হয়েছে, সকল মানুষ আমার অধীনস্ত দাস-দাসী। আল্লাহর কসম! আগামীতে আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আর কোন কাজের দায়িত্ব নেব না’।[2]

ইবনু হিববান বলেন, ‘সুলতান বা ক্ষমতাধরদের নিকট যাদের আনাগোনা ও ওঠাবসার সুযোগ ঘটে তাদের অবশ্য কর্তব্য হ’ল ক্ষমতাসীনের গালিকে গালি মনে না করা, তার কড়া কথা ও ব্যবহারকে কড়া মনে না করা এবং তার অধিকার প্রদানে গড়িমসি করাকে অপরাধ মনে না করা। কেননা তার কথা ও কাজের কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির মাঝেই ইয্যত প্রাপ্তির সুযোগ মিলবে’।[3]

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, কোন লোক ক্ষমতা লাভ করলে তার অনেক সঙ্গী-সাথী ক্ষমতা লাভের আগে সে তাদের সাথে যেমন আচরণ করত, ক্ষমতা লাভের পরেও তার থেকে তেমন আচরণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু তা না পাওয়ার দরুন তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টুটে যায়। এটা ঐ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যাশী সঙ্গীর অজ্ঞতা। সে যেন একজন মাতাল সঙ্গী থেকে তার স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থার সময়কালীন আচরণ কামনা করছে। এটা তো কখনো হবার নয়। কেননা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মাদকের মতই এক প্রকার নেশা, এমনকি তার থেকেও মারাত্মক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি নেশাকর না হ’ত তবে এই ক্ষমতার পূজারীরা কখনই চিরস্থায়ী পরকালের বদলে তা গ্রহণ করত না। সুতরাং তার নেশা চা-কফির নেশা থেকেও অনেক অনেক বেশী। আর চরম নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ-সবল মানুষের আচরণ লাভ অসম্ভব।[4] তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির মহান ব্যক্তিত্ব মূসা (আঃ)-কে মিশরের কিবতী (কপটিক) সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা ফেরা‘ঊনের সাথে বিনয়-নম্র ভাষায় সম্ভাষণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন,فَقُوْلاَ لَهُ قَوْلاً لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘তোমরা দু’জন তাকে নরম ভাষায় বুঝাও। হ’তে পারে সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (ত্বা-হা ২০/৪৪)। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ক বা ক্ষমতাসীনদের সাথে বিনম্র বচনে কথা বলা শরী‘আত, বিবেক, প্রথা ইত্যাদি সবকিছুরই দাবী। কিন্তু অনেক সময় লোকে তা করে উঠতে পারে না বলে সমস্যা সৃষ্টি হয়’।[5]

৮. অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনে আল্লাহর সাহায্য না পাওয়া : ইবনু রজব বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতালিপ্সু খুব কম লোকই এমন মেলে যার কাজে-কর্মে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য মেলে। বরং তাকে তার নিজের যিম্মায় সোপর্দ করা হয়। যেমনটা নবী করীম (ছাঃ) আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ)-কে বলেছিলেন,يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ، لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا، ‘হে আব্দুর রহমান! তুমি ইমারত বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চেয়ো না। কেননা চাওয়ার দরুন তোমাকে যদি তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তার নিকট সোপর্দ করা হবে; আর যদি না চাইতে তোমার তা মেলে তাহ’লে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[6]

ইয়াযীদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাওহিব ছিলেন একজন নেক্কার ও সুবিচারক। তিনি প্রায়শ বলতেন, যে সম্পদ ও সম্মান ভালবাসে, কিন্তু সেজন্য মুছীবতে পড়ার ভয় করে সে তাতে সুবিচার বজায় রাখতে পারে না।

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُوْنَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُوْنُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ  ‘অচিরেই তোমরা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব লাভের জন্য অবশ্যই পাগলপারা হয়ে উঠবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা আফসোসের কারণ হবে। তার সূচনা তো কত ভাল, কিন্তু তার পরিণতিটা কত মন্দ’![7]

৯. কাফির-মুশরিকদের সাথে সখ্যতা : কাফির-মুশরিকদের সঙ্গে মুসলিম রাজা-বাদশাহদের সখ্যতা ঐতিহাসিকভাবেই সুবিদিত। স্পেনের বাদশাহগণ এমনটা করে তাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করেছিলেন। বর্তমান যুগে অমুসলিম নাস্তিক মূর্তিপূজকদের সঙ্গে সখ্যতা ও তাদের আদর্শ গ্রহণে প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের কোন সংস্থার পদ লাভ, তাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিগ্রী কিংবা তাদের কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের আশায় তারা নিজেদের স্বকীয়তা বিকিয়ে দেয়।

১০. সত্য দ্বীন ইসলাম গ্রহণে অনীহা এবং বিদ‘আত ও বাতিল মত অবলম্বন : কবি আবুল আতাহিয়া বলেছেন,

أخي من عشق الرئاسة خفت أن *يطغى ويحدث بدعة وضلالة

‘ভাইয়া আমার, যে কি-না রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রেমে দিওয়ানা তার সম্পর্কে আমার ভয় হয় সে আল্লাহর দেয়া সীমালংঘন করবে অথবা বিদ‘আত ও বাতিল পথ অবলম্বন করবে’। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও জীবিকা দ্বীন গ্রহণের অন্যতম বাধা। আমরা ও আরো অনেকে শাসকদের পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তাদের সামনে যখন তাদের মতাদর্শ ভ্রান্ত বলে ধরা পড়েছে, তখন তারা বলেছে আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি তাহ’লে নিম্ন শ্রেণীর মুসলমান বলে গণ্য হব, আমাদের মান-মর্যাদা বলে কিছুই থাকবে না। অথচ দেখ, আমাদের জাতির ধন-সম্পদ, পদ-পদবী সব কিছুর উপর আমরা কর্তৃত্ব করছি, তাদের মাঝে আমাদের মর্যাদা কত উঁচুতে। ফেরাঊন ও তার দলবলের মূসা (আঃ)-এর অনুসরণে এছাড়া আর কোন বাধা ছিল কি’?[8]

তিনি আরো বলেছেন, মানবকুলে কিছু লোক সব সময়ই বাতিলকে গ্রহণ করে। কিছু লোক তা গ্রহণ করে অজ্ঞতা এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সুধারণা হেতু তার অন্ধঅনুসরণ বশত। আবার কেউ বাতিলকে বাতিল জেনেও অহঙ্কার ও বাড়াবাড়ি বশত তা অবলম্বন করে। কেউবা আবার জীবিকা, পদ কিংবা ক্ষমতার লোভে পড়ে বাতিলকে অাঁকড়ে ধরে। কেউবা হিংসা ও বিদ্বেষবশত তা অবলম্বন করে। অনেকে আবার প্রেম-ভালবাসায় মজে গিয়ে তা গ্রহণ করে। কেউবা আবার ভয়ে এবং কেউবা আরাম-আয়েশে বিভোর হয়ে বাতিলকে বেছে নেয়। সুতরাং কুফর অবলম্বনের কারণ শুধুই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও জীবন-জীবিকার প্রতি ভালবাসা নয়’।[9]

১১. রাজা-বাদশাহদের প্রিয়পাত্র হওয়া এবং তাদের সাথে ওঠাবসা করা : ইবনু রজব বলেছেন, যালিম সরকারের নিকট যে বা যারা যাতায়াত করে তাদের বেলায় বড় ভয় যা জাগে তা হ’ল, তাদের মিথ্যা কথাকে এরা সত্য বলে সত্যায়ন করবে এবং তাদের যুলুম-অত্যাচারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। হ’তে পারে সে সাহায্য বাধা না দিয়ে নীরব থাকার মাধ্যমে। কেননা যে সম্মান ও ক্ষমতার মোহে ক্ষমতাধরদের দরবারে যাতায়াত করে, স্বভাবতই সে তাদের কোন কিছুতে নিষেধ করতে যাবে না। বরং অধিকাংশ সময় সে তাদের মন্দ কাজ-কর্ম খুব সুন্দর কাজ বলে আখ্যায়িত করে তাদের নৈকট্য লাভের জন্য। যাতে করে তাদের নিকট তার অবস্থান ভাল হয় এবং তার উদ্দেশ্য সাধনে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

কা‘ব ইবনু উজরা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, শীঘ্রই আমার পরে কিছু শাসকের আবির্ভাব ঘটবে। যারা তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করবে আর তাদের মিথ্যাকে সত্য গণ্য করবে এবং তাদের যুলুম-নিপীড়নে সাহায্য-সহযোগিতা করবে তারা না আমার দলভুক্ত থাকবে, না আমি তাদের দলভুক্ত থাকব। তারা (কিয়ামতের দিন) হাওযে কাওছারের তীরে অবতরণ করতে পারবে না। আর যারা তাদের সাথে ওঠা-বসা করবে না, তাদের যুলুম-নির্যাতনে সহযোগিতা করবে না এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য গণ্য করবে না তারা আমার দলভুক্ত এবং আমিও তাদের দলভুক্ত। তারা হাওযে কাওছারে অবতরণ করবে’।[10]

পূর্বসূরিদের অনেকেই এজন্য যারা রাজা-বাদশাহদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে আগ্রহ প্রকাশ করত তাদেরকে ওদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেই নিষেধ করতেন। এই নিষেধকারীদের মধ্যে রয়েছেন ওমর বিন আব্দুল আযীয, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সুফিয়ান ছাওরী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, আমাদের মতে, যে শাসকদের নিকট যায় এবং তাদের আদেশ-নিষেধ করে সে আদেশদাতা ও নিষেধকর্তা নয়; বরং  যে তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলে সেই  আদেশদাতা ও নিষেধকর্তা।

এর কারণ, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও উঠা-বসায় ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। দূর থেকে মনে হয় শাসকদের সে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে, মন্দ কাজের জন্য হম্বি তম্বি করবে। কিন্তু যখন কাছে আসে তখন আর এ সবের কোনটাই হয়ে ওঠে না; বরং মন তাদের দিকে ঝুঁকে যায়। কেননা পদ ও মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা তো মানুষের মনের মাঝে সুপ্ত থাকে। এসব পাবার পথ যখন সে খোলা দেখতে পায় তখন সে শাসকদের আদেশ-নিষেধ না করে বরং তাদের তেল মালিশ ও খয়েরখাঁ গিরি করতে থাকে। এমন করতে গিয়ে এক সময় সে ঐ অন্যায়-অপকর্মকারী যালিম শাসকদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের ভালবাসতে শুরু করে। বিশেষ করে শাসকরা যদি তার সম্মান দেয় এবং মূল্যায়ন করে তখন তো সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ তাঁর পিতার উপস্থিতিতে জনৈক শাসকের স্ত্ততি করলে তার পিতা তাউস তাকে এজন্য ধমকান।

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) আববাদ ইবনু আববাদকে একটি পত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, আমীর-উমারার কাছে ঘেঁষা থেকে সাবধান থাকবে। কোন ব্যাপারেই তাদের সাথে মাখামাখি করবে না। তুমি সুপারিশ করলে কাজ হবে। একজন মাযলূম বা নির্যাতিত ব্যক্তি তোমার কথায় রেহাই পাবে কিংবা তুমি কোন যুলুম রোধ করতে সক্ষম- এ জাতীয় কথায় কখনো বিভ্রান্ত হয়ো না। এসবই ইবলীসী ধোঁকা। জ্ঞানপাপীরা এগুলোকে তাদের উন্নতির সিঁড়ি বানায়। তোমার পক্ষে যদি মাসআলা ও ফৎওয়া জিজ্ঞাসার উত্তর না দিয়ে থাকা সম্ভব হয়, তাহ’লে তুমি সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে কর। মুফতী আলেমদের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে যেয়ো না। আমার কথা মত কাজ হোক, আমার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক, আমার কথা শোনা হোক- ইত্যাকার বাসনাকে মনে প্রশ্রয় দেওয়া থেকে খুব সাবধান থেকো। এমনটা যাদের ইচ্ছে, তাদের ইচ্ছের ব্যত্যয় ঘটলে তারা আর সুস্থির থাকে না। আর রাষ্ট্রক্ষমতা প্রীতি থেকে তুমি অবশ্যই দূরে থেকো। কেননা সোনা-রূপা থেকেও লোকদের নিকট রাষ্ট্রক্ষমতার মোহ অনেক বেশী প্রিয়। এ এক অদৃশ্যমান দরজা। শিক্ষিত অভিজ্ঞজনদের ছাড়া কেউ তা দেখতে পায় না। সুতরাং অন্তর দিয়ে সত্যকে তালাশ কর এবং নিয়ত বেঁধে কাজ কর। জেনে রাখ মানুষের সামনে অবস্থা এমন ঘনিয়ে আসছে যে, তাতে সে মরণ বরণ করতে চাইবে। সালাম জানিয়ে এখানেই শেষ করছি’।[11]

ওহাব বিন মুনাবিবহ বলেছেন, ধন-সম্পদ মজুদ করা এবং শাসকের সাথে উঠা-বসা মানুষের কোন পুণ্য অবশিষ্ট রাখে না। যেমন করে একটা ছাগলের খোয়াড়ে দু’টা ক্ষুধার্ত হিংস্র নেকড়েকে ছেড়ে দিলে তারা একটা ছাগলও আস্ত রাখে না। রাতারাতিই সব সাবাড় করে দেয়।[12]

আবু হাযেম (রহঃ) বলেছেন, এক সময় আলেমরা শাসকদের থেকে পালিয়ে থাকত, আর তারা তাদের খুঁজে নিত। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আলেমরা শাসকদের দরজায় ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকে আর শাসকরা তাদের দেখা দিতে চায় না।[13]

১২. খ্যাতির মোহ:

ইবনু রজব বলেছেন, বিদ্যা ও কর্মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল/লাভের চেষ্টা একটি অনভিপ্রেত বিষয়। ব্যক্তির বিদ্যাবুদ্ধি, সাধনা ও দ্বীন-ধার্মিকতা চর্চার মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভের মোহ খুবই গর্হিত বিষয়। অনুরূপভাবে লোকেরা দো‘আ, বরকত লাভের আশায় কিংবা হাতে চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্যে দলে দলে তার সাক্ষাতপ্রার্থী হবে বলে সেই লক্ষ্যে কাজ করা, কথা-বার্তা বলা এবং কারামত যাহির করাও গর্হিত কাজ। কিন্তু খ্যাতির মোহে অন্ধজন এসব গর্হিত ও অবাঞ্ছিত কাজ করতে ভালবাসে। নিষ্ঠার সাথে এগুলো করে এবং এসবের উপকরণ যোগাতে চেষ্টা করে। এতেই তার যত আনন্দ। এ কারণেই সালাফে ছালেহীন (পূর্বসূরি সৎকর্মশীল বান্দাগণ) খ্যাতিকে ভীষণভাবে অপসন্দ করতেন। তাঁদের মাঝে রয়েছেন আইয়ূব সাখতিয়ানী, ইবরাহীম নাখঈ, সুফিয়ান ছাওরী, আহমাদ বিন হাম্বল প্রমুখ আল্লাহওয়ালা আলেম এবং ফুযাইল বিন আইয়ায, দাঊদ তাঈ প্রমুখ সাধক ও দরবেশ। তাঁরা খুব করে আত্মনিন্দা করতেন এবং নিজেদের আমল সমূহকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতেন।[14]

১৩. জনতার মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শোনার বাসনা :

ইবনু রজব বলেছেন, ক্ষমতাবান ও প্রতিপত্তিশালীরা মানুষের মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শুনতে ভালবাসে। তারা জনগণের কাছে তা দাবীও করে। যারা তাদের প্রশংসা করে না তাদেরকে তারা নানাভাবে কষ্ট দেয়। অনেক সময় তারা একাজে এতটাই বাড়াবাড়ি করে বসে যে প্রশংসা থেকে নিন্দাই তাদের বেশী পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোন কোন সময় তারা তাদের দৃষ্টিতে ভাল কাজ করছে বলে যাহির করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাদের মন্দ অভিপ্রায় কাজ করে। এভাবে মিথ্যাকে সত্যের আবরণে আচ্ছাদিত করতে পেরে তারা উৎফুল্ল হয় এবং লোকদের থেকে প্রশংসা লাভ ও তাদের মাঝে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ার আকাঙ্খা পোষণ করে। এমন লোকদের প্রসঙ্গেই আল্লাহ বলেন,

لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ-

‘যেসব লোকেরা তাদের মিথ্যাচারে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভাব না যে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)

এ আয়াত এরূপ বিনাকাজে প্রশংসার জন্য লালায়িতদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ মানবকুল থেকে প্রশংসা তলব করা, প্রশংসা পেয়ে খুশি হওয়া এবং প্রশংসা না করার দরুন শাস্তি দেওয়া কেবলমাত্র লা শরীক আল্লাহর জন্যই মানায়। এজন্যই সৎপথপ্রাপ্ত ইমামগণ তাদের কাজ-কর্মের দরুন তাদের প্রশংসা করতে নিষেধ করতেন। মানুষের কোন কল্যাণ করার জন্য তাদের স্বত-স্ত্ততি করতে দিতেন না; বরং সেজন্য অংশীদার শূন্য এক আল্লাহর প্রশংসা করতে তারা বেশী বেশী উদ্বুদ্ধ করতেন। কেননা সকল প্রকার নে‘মত ও অনুগ্রহের মালিক তো তিনিই।

খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয এ ব্যাপারে খুবই সংযত ছিলেন। একবার তিনি হজ্জে আগত লোকদের পড়ে শোনানোর জন্য একটি পত্র প্রেরণ করেন। তাতে তিনি তাদের উপকার করতে আদেশ দেন এবং তাদের উপর যে যুলুম-নিপীড়ন জারী ছিল তা বন্ধ করতে বলেন। ঐ পত্রে এও ছিল যে, এসব কল্যাণ প্রাপ্তির দরুন তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রশংসা কর না। কেননা তিনি যদি আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করতেন তাহ’লে আমি অন্যদের মতই হ’তাম। তাঁর সঙ্গে সেই মহিলার ঘটনা তো সুপ্রসিদ্ধ, যে তার ইয়াতীম মেয়েদের জন্য খলীফার নিকট ভাতা বরাদ্দের আবেদন জানিয়েছিল। মহিলাটির চারটি মেয়ে ছিল। খলীফা তাদের দু’জনের ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন। ঐ মহিলা আল্লাহর প্রশংসা করে। কিছুকাল পর তিনি তৃতীয়জনের জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন। এবারও মহিলা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তার শুকরিয়া প্রকাশের কথা জেনে খলীফা তাকে বলেন, আমরা তাদের জন্য ভাতা বরাদ্দ করতে পেরেছি। আপনার এভাবে প্রশংসার প্রকৃত হকদারের প্রশংসা করার জন্যেই। এখন আপনি ঐ তিনজনকে বলবেন, তারা যেন চতুর্থজনের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়। তিনি এর দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রের নির্বাহী পদাধিকারী কেবলই আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে নিযুক্ত। তিনি আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর আনুগত্যের হুকুমদাতা এবং তাঁর নিষিদ্ধ জিনিসগুলো থেকে নিষেধকারী মাত্র। আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর মাধ্যমে তিনি তাদের কল্যাণকামী। তার বিশেষ চাওয়া-পাওয়া যে, দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে থাক এবং ইয্যত-সম্মান সব আল্লাহর হোক। তারপরও তার সদাই ভয় হ’ত যে, তিনি আল্লাহর হক আদায়ে কতইনা ত্রুটি করে ফেলছেন।[15]

১৪. আল্লাহর নামে মিথ্যাচার ও মনগড়া কথা বলা :

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, যেসব শিক্ষিত লোক পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয় এবং দুনিয়াকে ভালবাসে তারা নিজেদের ফৎওয়া, আদেশ, বার্তা, বিধি-বিধান জারী করতে আল্লাহ তা‘আলার নামে নাহক কথা বলে। কেননা মহান প্রভুর বিধি-বিধান বহুক্ষেত্রে মানুষের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। বিশেষতঃ রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী এবং খেয়াল-খুশির অনুসারীদের তো তা মোটেই হয় না। তাদের আশা-উদ্দেশ্য তো সত্যের বিরোধিতা এবং তাকে বাধা না দেওয়া অবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূরণই হয় না। সুতরাং আলেম ও শাসক যখন ক্ষমতালিপ্সু ও খেয়াল-খুশির অনুসারী হবে, তখন তাদের সে আশা হক বা ন্যায়নীতিকে পদদলিত না করে করায়ত্ব হবে না। বিশেষতঃ যখন সে তার উদ্দেশ্যের পেছনে একটা প্যাঁচঘোচ দাঁড় করাতে পারে,  তখন সে ঐ সন্দেহের পথে এগিয়ে যায় এবং খেয়াল-খুশিকে উষ্কে দেয়। ফলে যা ছিল সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত তা ঢাকা পড়ে যায়। আর যদি হক এতটাই স্পষ্ট হয় যে, তাতে কোন রকম কোন অস্পষ্টতা ও সন্দেহের অবকাশ নেই তাহ’লে সে তার বিরোধিতা শুরু করে। মুখে সে বলে, সময়কালে তওবা করলেই মুক্তির রাস্তা খুলে যাবে। এদেরই মত লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا ‘তাদের পরে এলো তাদের অপদার্থ উত্তরসূরিরা। তারা ছালাত বিনষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। ফলে তারা অচিরেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (মারিয়াম ১৯/৫৯)। তাদের প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন,

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ أَنْ لَا يَقُولُوا عَلَى اللهِ إِلاَّ الْحَقَّ وَدَرَسُوا مَا فِيهِ وَالدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

‘অতঃপর তাদের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় এমনসব অপদার্থ লোক, যারা কিতাবের (তাওরাতের) উত্তরাধিকারী হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা তুচ্ছ পার্থিব উপকরণ হাছিল করে (অর্থাৎ ঘুষ খায়) আর বলে যে, আমাদের ক্ষমা করা হবে (কেননা আমরা নবীদের বংশধর ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র)। এমনি ধরনের পার্থিব উপকরণ যদি তাদের নিকট পুনরায় আসে, তাহ’লে তারা তা নিয়ে নিবে (অর্থাৎ পুনরায় একই পাপ করবে)। তাদের নিকট থেকে কি তাদের কিতাবে এই অঙ্গীকার নেওয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর নামে সত্য ব্যতীত কিছুই বলবে না? আর সেখানে যা (প্রতিশ্রুতি) লিখিত আছে তাতো তারা পাঠ করেছে। বস্ত্ততঃ আললাহভীরুদের জন্য পরকালের গৃহ উত্তম, তোমরা কি তা বুঝ না’? (আ‘রাফ ৭/১৬৯)

আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতে অবগত করছেন যে, প্রবৃত্তির পূজারীরা পার্থিব সম্পদ তাদের জন্য হারামের কথা জেনেও কুক্ষিগত করছে। আর বলছে, আমাদেরকে সামনের দিনে মাফ করে দেওয়া হবে। অনুরূপ হারাম সম্পদ হাতে পেলে তারা আবারও তা গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে তারা সব সময়ে চার হাত-পায়ে খাড়া। তারা বলে, আমাদের এ কথাই আল্লাহর বিধান, আল্লাহর শরী‘আত এবং আল্লাহর দ্বীন। অথচ তারা খুব ভাল করেই জানে যে, আল্লাহর বিধান, শরী‘আত ও দ্বীন-এর উল্টোটা। তারা কি জানে না কোনটা আল্লাহর হুকুম, শরী‘আত ও দ্বীন? ফলত তারা কখনও না জেনে, না বুঝে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলে। আবার কখনও বাতিলের কথা জেনে-বুঝে তার নামে মিথ্যা বলে। কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা জানে পরকাল ইহকাল থেকে শ্রেষ্ঠ। তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি ও পাশবিক লালসা তাদেরকে আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করে না। তাদের পন্থা এই যে, তারা কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে, ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। দুনিয়ার নশ্বরতা ও নিকৃষ্টতা নিয়ে ভাববে এবং আখিরাতের সৌভাগ্য ও স্থায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করবে। ঐ দুনিয়াপূজারীরা পাপাচারিতার সাথে সাথে দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতও উদ্ভাবন করে। ফলে তাদের পাশে দু’টো জিনিস জমা হয়। কেননা খেয়াল-খুশির অনুসরণের ফলে মানুষের দিলের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ফলে সে সুন্নাত ও বিদ‘আতের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। অথবা উল্টো বুঝে বিদ‘আতকে সুন্নাত এবং সুন্নাতকে বিদ‘আত বলে। এটাই আলেমদের বিপদ। তারা যখন দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয় এবং ক্ষমতাপ্রীতি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তখন তারা উক্ত আচরণই করে। তাই তো আল্লাহ বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ، وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ-

‘আর তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়ে দাও, যাকে আমরা আমাদের অনেক নিদর্শন (নে‘মত) প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে তা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ সুপথ ছেড়ে বিপথে গিয়েছিল)। ফলে শয়তান তার পিছু নেয় এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’। ‘যদি আমরা চাইতাম তাহ’লে উক্ত নিদর্শনাবলী অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে অবশ্যই তার মর্যাদা আরও উন্নত করতে পারতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ল ও স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসারী হ’ল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-৭৬)। এই তো মন্দ আলেমের উদাহরণ যে তার ইলমের উল্টো কাজ করে।[16] ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে নেতৃত্বের লোভ একটি।[17]

১৫. মন শক্ত হয়ে যাওয়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর যিকির থেকে বিরত থাকা :

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসার ন্যূনতম ক্ষতি এই যে, তা আল্লাহর ভালবাসা ও যিকির থেকে মনকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়। আর যার ধন-সম্পদ, ক্ষমতালিপ্সা তাকে আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ করে দেয়, সে ক্ষতিগ্রস্তদের শ্রেণীভুক্ত। আর মন যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে পড়ে, তখন শয়তান সেখানে বাসা বাঁধে এবং যেদিকে খুশি তাকে পরিচালিত করে’।[18]

১৬. শত্রুতা এবং পারস্পরিক অনৈক্য সৃষ্টি :

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী ব্যক্তি মানেই প্রতিপক্ষকে অযোগ্য, অথর্ব ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাকে সে রাজনীতির ময়দান থেকে উৎখাত করতে বা দূরে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা। তখন ব্যর্থতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এজন্যই আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ ‘আপোষে ঝগড়া করো না। তাহ’লে তোমরা হীনবল হবে ও তোমাদের শক্তি উবে যাবে’ (আনফাল ৮/৪৬)

[চলবে]

[1]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া ১৪/৩২৩ পৃঃ।

[2]. মুস্তাদরাকে হাকিম ৩/৩৪৯, হাকিম হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।

[3]. রাওযাতুল উকালা ওয়া নুযহাতুল ফুযালা, পৃঃ ২৬৭।

[4]. এজন্যই সরকারী ক্ষমতা লাভকারীদের বিরোধী শক্তির উপর যুলুমের স্টীম-রোলার চালাতে দেখা যায় এবং সরকারী সম্পদ ও জনগণের জান-মাল তছরুফের তারা কোনই পরোয়া করে না। বিনয়-নম্র আচরণের মাধ্যমে হয়তো তাদের পথে আনা যেতে পারে।-অনুবাদক

[5]. বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ৩/৬৫২।

[6]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।

[7]. বুখারী হা/৭১৪৮; শারহু হাদীছ মাযেবানে জা‘য়েআনে, পৃঃ ২৯।

[8]. হিদায়াতুল হায়ারা, পৃঃ ২৩।

[9]. , পৃঃ ২৩।

[10]. তিরমিযী হা/২২৫৯, হাদীছ ছহীহ।

[11]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জা‘য়েআনে, পৃঃ ৬৪-৬৮।

[12]. জামেউ বায়ানিল ইলম, পৃঃ ২০২।

[13]. , পৃঃ ১৯৯।

[14]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৬৮।

[15]. , পৃঃ ৪১-৪৩।

[16]. আল-ফাওয়াইদ, পৃঃ ১০০।

[17]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ১৮/৪৬।

[18]. উদ্দাতুছ ছাবিরীন, পৃঃ ১৮৬।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member